
কবর কত প্রকার? কবরের আজাব কার হয়? কোথায় হয়?
মেজাজি কবর ও হাকিকি কবর
কবর দুই প্রকার : একটি মেজাজি কবর, অপরটি হাকিকি কবর; একটি রূপক কবর, অপরটি আসল কবর। রূপক কবর দিয়ে আসল কবরকে চিনতে হয়, জানতে হয়, বুঝতে হয়। একটি মূর্ত, অপরটি বিমূর্ত। একটি চোখে দেখা যায়, অপরটি চোখে দেখা যায় না। যে কবরটি চোখে দেখা যায় না উহার পরিচয় দেবার জন্যই মূর্ত কবরের প্রয়োজন হয়, রূপক কবরের প্রয়োজন হয়, মেজাজি কবরের প্রয়োজন হয়। মেজাজি কবরকেই একমাত্র কবর মনে করলে চিন্তার বাঁধনে বিরাট গন্ডগোল লেগে যায়। মাটির গর্তটি মেজাজি কবর, রূপক কবর, মূর্ত কবর। তাই সহজেই চোখে দেখা যায়। জীবন্ত দেহটি জীবাত্মার হাকিকি কবর, আসল কবর, মূর্ত কবর। জীবন্ত দেহ-কবরে জীবাত্মা বাস করে। জীবাত্মা অবস্থান করলেই দেহটি জীবন্ত থাকে। এই জীবন্ত দেহ-কবরেই হরদম জীবাত্মার আজাব ভোগ করতে হচ্ছে। আজাবের মাত্রা কখনো ছোট, কখনো মাঝারি, কখনো ভারি, কখনো অসহনীয় ভারি। জীবন্ত দেহের মাঝে ছোটবড় সব রোগগুলো এক একটি কবরের আজাব। এই কবরের আজাব কখনো সহ্য করা যায়, কখনো সহ্য করা যায় না। অতিমাত্রায় অসহ্য আজাব যখন এই জীবন্ত দেহটি ভোগ করতে থাকে, তখনই আত্মহত্যার প্রবণতাটি দেখা দেয়। জীবন্ত দেহটি হতে যখন জীবাত্মা বাহির হয়ে যায় তখন সেই জীবন্ত দেহটিকে লাশ বলা হয়। জীবাত্মা বিহনে দেহটি আর সচল থাকে না, একদম অচল এবং অথর্ব রূপ ধারণ করে। এই অচল এবং অথর্ব দেহটিকেই লাশ বলা হয়। জীবাত্মা আমি স্বয়ং, দেহ-খাঁচাটি আমি নই। আমার দেহ-খাঁচাটির মাপ মোটামুটি সাড়ে তিন হাত। যে আমি নামক জীবাত্মা দেহ হতে বাহির হয়ে যাই, সেই জীবাত্মার মাপ কয় হাত? জীবাত্মা মাপা যায় না, কারণ জীবাত্মা দেখা যায় না। যাহা দেখা যায় না উহাকে নিরাকার বলে। জীবাত্মাকে আরবি ভাষায় নফ্স বলা হয়। এই জীবাত্মা তথা নফ্স আল্লাহর সৃষ্টি, কারণ জীবাত্মা তথা নফ্স মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে। কিন্তু জীবাত্মার পাশেই রূহ তথা পরমাত্মাটিকে ফুৎকার করে দেওয়া হয়েছে। পরমাত্মা তথা রূহ আল্লাহর হুকুম, আল্লাহর আদেশ, আল্লাহর আমর। আল্লাহর হুকুম তথা আল্লাহর আদেশ আল্লাহ্ হতে আলাদা নয়। চরম সত্যে তথা উলঙ্গ সত্যে পরমাত্মা তথা রূহ আল্লাহ স্বয়ং। এই পরমাত্মা তথা রূহ জন্ম দেন না, জন্মগ্রহণ করেন না। ইহার আদি ও অন্ত নাই। ইহা এক ও একক। ইহা সয়ম্ভু। পরমাত্মা তথা রূহ ঘুমায় না, তাই জাগরণের প্রশ্নটি অবান্তর। পরমাত্মা তথা রূহ-এর ক্লান্তি ও অবসাদ নাই, তাই জাগরণের প্রশ্নটি অবান্তর। এই পরমাত্মা তথা রূহ আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টিরাজ্যের মধ্যে তিনটি স্থান ব্যতীত কোথাও থাকে না। এই তিনটি স্থানের নাম হল : প্রথমটি লা মোকাম, তারপর জিনের অন্তর, এবং তারপর মানুষের অন্তর। এই তিনটি স্থানেই পরমাত্মা তথা রূহ স্বয়ং জাত-রূপে অবস্থান করে। আর কোথাও পরমাত্মা বা রূহ-এর অবস্থান করার কথাটি সমগ্র কোরানের কোথাও নাই। তাই কোরান প্রকাশ্যে ঘোষণা করছে, ‘আমরা তোমাদের শাহারগের নিকটেই আছি।’ কোন জীব-জন্তু, কোন গৃহপালিত পশু অথবা কোন হিংস্র জানোয়ারের শাহারগের নিকটে রূহ থাকার কোন দলিল পাওয়া যায় না। সুতরাং সমস্ত প্রাণীকুল, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, হাঙ্গর-কুমির, মাছ প্রত্যেকের নফ্স আছে, কিন্তু পরমাত্মা তথা রূহ নাই। মানুষ এবং জিনের নফ্সের সঙ্গে পরমাত্মা তথা রূহ অবস্থান করছে বলেই এই দুুইটি প্রাণীকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বলা হয়েছে। কারণ পরমাত্মা তথা রূহ যত ক্ষুদ্র রূপেই থাক না কেন, যত অণুপরমাণু রূপেই থাক না কেন, সেই জীবাত্মা তথা নফ্স, পরমাত্মা তথা রূহ-এর বহনকারী। যেহেতু জিন এবং মানুষ এ দু’টি জীব পরমাত্মাকে বহন করে চলেছে, তাই তারা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। অন্যথায় সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। যেহেতু আল্লাহ স্বয়ং রূহ-রূপে মানুষ এবং জিন নামক প্রাণীতে অবস্থান করছেন, তাই তাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটির কর্তৃত্ব দান করা হয়েছে। তাই মানুষকে আল্লাহর খলিফা বলা হয়েছে। আদম আল্লাহর খলিফা, সুতরাং আদমের বংশধরেরাও আল্লাহর খলিফা। হাতি, সিংহ, বাঘ, গন্ডার, নীল তিমি যত বড়ই হউক না কেন, যত শক্তিশালীই হউক না কেন, এদের নফ্সের সঙ্গে রূহ দেওয়া হয় নি, তাই এইসব প্রাণীকুলের নফ্স নিম্নমানের এবং নির্বাচন করার ক্ষমতা হতে বহিভূর্ত; তাই এইসব প্রাণীকুল তৌহিদে বাস করে। সুতরাং এই প্রাণীকুল মনের অজান্তে সবাই মুসলমান। এই সূক্ষ্ন বিষয়টির গবেষণা করতে গিয়ে গবেষকেরা তালগোল পাকিয়ে ফেলে, তাই এদের গবেষণার লেখাসমূহে আত্মবিরোধের ঝুড়ি পাওয়া যায়। এইসব গবেষকেরা মনে করেন যে, অনেক কিছু অবদান রাখলাম, কিন্তু মনের অজান্তে কতগুলো ভুলের ঝুড়ি পাঠকদের উপহার দিয়ে যায়। ইহাকেই অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী বলা হয়। ইহাদের লিখনিতে রস আছে, কিন্তু মূল বিষয়ের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের প্রশ্নে বিরাট শূন্য।
প্রাণীকুল যেহেতু তৌহিদে বাস করে তাই এরা মুসলমান : এরা আল্লাহকে সেজদা করছে, করে এবং চিরদিন করবে। মাথা নত করাকেও সেজদা বলে। এই মাথা নত করাটাকেই মেজাজি সেজদা বলা হয়। ইহা কখনোই হাকিকি সেজদা নয়। হাকিকি সেজদাতে মাথা নত করলেও চলে, না করলেও চলে। মানুষ মেজাজি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহকে সেজদা দিচ্ছে, আবার আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলো অমান্য করছে; কিন্তু হাকিকি সেজদা তথা আসল সেজদায় আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অমান্য করার প্রশ্নই আসতে পারে না, কারণ ইহা দায়েমি সেজদা, মেজাজি সেজদা নয়। মেজাজি সেজদার পটপরিবর্তন হয়, কিন্তু হাকিকি সেজদার পটপরিবর্তনের প্রশ্নই আসে না, কারণ ইহাই দায়েমি সেজদা। মেজাজি নামাজিকে ওয়াইল নামক দোজখের ভয় দেখানো হয়েছে কোরানে। দায়েমি নামাজিকে এ রকম ভয় দেখাবার প্রশ্নই আসতে পারে না; কারণ মহানবী বলছেন যে, ‘ওয়াক্তিয়া নামাজ হতে অনেক বেশি দায়েমি নামাজের মর্যাদা।’ স্বয়ং কোরান ঘোষণা করছে, ‘মুসল্লি সে-ই, যে দায়েমি নামাজের মধ্যে অবস্থান করে’। মেজাজি নামাজ আদর্শলিপি পাঠ করা শেখায়, সুতরাং মেজাজি নামাজের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার অবকাশ নাই। গবেষকরা যখন মেজাজি নামাজকেই একমাত্র নামাজ বলে ধরে নেন, তখনই মূল দর্শন হতে ছিটকে পড়েন এবং ভুল দর্শন প্রচার করেন। এই ভুল দর্শনের ফলে মতভেদের সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে দায়েমি নামাজের দর্শনটি হারিয়ে যেতে থাকে এবং মেজাজি নামাজটি একমাত্র নামাজ বলে প্রতীয়মান হয়। কোনো একজন পরিচিত লোক বলেছেন যে, একটি মিথ্যাকে সতেরবার ‘সত্য সত্য’, বলে প্রচার করলে ইহাতে সত্যের তাছির পরিলক্ষিত হয়। লোকটির দর্শন যদিও হালকা দর্শন, কিন্তু প্রয়োগের বেলায় সর্ববিষয়ে, সর্বদর্শনে ইহার তাছির আমরা হরহামেশা দেখতে পাই। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, একটি বিষয়ের কথা বলতে গিয়ে অনেক বিষয়ের কথা আপনি এসে পড়ে, অনেকটা কান টানলে মাথা আসার মতো, তাই অধম লেখক নিরুপায় হয়ে এতগুলো বিষয়ের অবতারণা করেছি।
এবার আমরা যে বিষয়টি নিয়ে প্রথমে আলোচনা করেছি সেই বিষয়ে ফিরে গেলাম। জীবাত্মা বিহনে জীবন্ত দেহটি যখন লাশে পরিণত হয় তখনই সেই লাশটিকে মেজাজি গর্ত নামক মেজাজি কবরে ইজ্জতের সাথে শোয়ায়ে দেই এবং বাঁশ, চাটাই ও মাটি দিয়ে ঢেকে দেই। এই বাঁশ-চাটাই, মাটি দিয়ে ঢেকে রাখা কবরটিকেই মেজাজি কবর বলা হয়। এই কবরে কেবল লাশটি অবস্থান করে, জীবাত্মা নয়। সুতরাং জীবাত্মা তথা নফ্স তথা আমার এই রকম মেজাজি কবরে প্রবেশ করার প্রশ্নই আসে না। সুতরাং যে মেজাজি কবরে আমি নাই অথচ লাশটি আছে, সেই কবরে আজাব হবার কথাটি ধরে নিতে হয়। এই মেজাজি কবরে নফ্স তথা আমি থাকলে তো আজাব হবে। আমি নাই, আছে আমার লাশটি। সুতরাং আজাবের প্রশ্নটি পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। মেজাজি কবরে আমি থাকলে তো শাস্তি হবে। যেহেতু আমি মেজাজি কবরে নাই, তাহলে শাস্তির প্রশ্নটিও মেজাজি। সুতরাং মেজাজি কবরটি হল আসল কবরের পরিচয় জানার আদর্শলিপি। অংক, এলজেবরা এবং গণিতের যে রকম ধারাবাহিক ফর্মুলা থাকে, সে রকম ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে ফর্মুলা আছে। এই ফর্মুলার প্রত্যেকটির দুইটি রূপ আছে : একটি মেজাজি এবং অপরটি হাকিকি।
শয়তান দুই প্রকার : একটি মেজাজি শয়তান, অপরটি হাকিকি শয়তান। মেজাজি শয়তান পৃথিবীর একটি দেশের একটি নগরীর একটি বিশেষ স্থানে অবস্থান করে : সেই দেশটির নাম সৌদি আরব, সেই নগরীর নাম পবিত্র মক্কা নগরী, সেই বিশেষ স্থানটির নাম মিনা। এই মিনাতেই তিনটি মেজাজি শয়তান অবস্থান করছে : একটি বড়, একটি মাঝারি এবং একটি ছোট। এই শয়তান তিনটিকে হাজিরা কংকর ছুড়ে মারেন। হাজিরা জানেন না যে, এই তিনটি শয়তান যে পাথর দিয়ে বানানো হয়েছে সেই পাথরগুলো তৌহিদে বাস করে। হাজিরা জানেন না যে, যে কংকরগুলো এই তিনটি মেজাজি শয়তানকে ছুড়ে মারেন সেই কংকরগুলোও তৌহিদে বাস করে। হাজিরা জানেন না যে, তাদের যে হাত দিয়ে কংকরগুলো ছুড়ে মারেন সেই হাতগুলোও তৌহিদে বাস করে। হাজিরা জানেন না যে, তৌহিদে বাস করে না কেবল একটি জিনিস : সেই জিনিসটি হল প্রতিটি হাজির প্রতিটি অন্তর। এই তিনটি মেজাজি শয়তানকে হাজিরা যে কংকর ছুড়ে মারেন, এই মারাটাই আসল শয়তানকে চিনবার, জানবার এবং বুঝবার একটি উজ্জ্বল এবং পবিত্র আদর্শলিপি। সুতরাং এই আদর্শলিপিকে এড়িয়ে যাওয়া, গুরুত্ব না দেওয়া, এবং একটি হাল্কা বিষয় বলে উড়িয়ে দেওয়া মোটেই ঠিক নয়, কারণ এই প্রেসক্রিপশন তথা ব্যবস্থাপত্রটি মহানবী দিয়ে গেছেন।
হিন্দু-শাস্ত্রে চিতা তথা শ্মশান দুই প্রকার : একটি মেজাজি চিতা তথা শ্মশান, এবং অপরটি হাকিকি তথা আসল শ্মশান। আসল শ্মশান তথা চিতাতে জীবাত্মাবহনকারী জীবন্ত দেহটি প্রতিনিয়ত বৈষয়িক চিতার লেলিহান আগুনে জ্বলছে। মুসলমান-শাস্ত্রে জীবন্ত দেহটিকে যেমন কবর বলা হয়, তেমনি হিন্দু-শাস্ত্রে জীবন্ত দেহটিকে জ্বলন্ত আগুনের চিতা বা শ্মশান বলা হয়। অপরপক্ষে মেজাজি চিতা তথা শ্মশানে জীবাত্মা তথা নফ্স না থাকা মৃত দেহটিকে দাহ করা হয়। সুতরাং নফ্স তথা আমি কখনোই মেজাজি তথা রূপক চিতা তথা শ্মশানে জ্বলব না, জ্বলছি না এবং কোনদিনও জ্বলি না। কারণ মেজাজি চিতা বা শ্মশানে আমার অবস্থানটি নাই, আছে কেবল আমার মৃতদেহটি। সুতরাং আমার মেজাজি চিতা তথা শ্মশানে জ্বলার তথা দাহ করার অগ্নিজ্বালা অনুভব করার প্রশ্নটি আসতে পারে না। কারণ জীবাত্মা তথা নফ্সটির বাহন হল এই দেহটি। বাহন কখনো আমি নই; সুতরাং মেজাজি কবর অথবা মেজাজি শ্মশানে আমার থাকার প্রশ্নটি অবান্তর। ট্রেন অথবা মোটর গাড়ির একসিডেন্টে পুরো পা-টি দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, সেই পা-টি আমার চোখের সামনে পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দিলে, অথবা কোন গর্তে মাটি-চাপা দিয়ে রাখলে আমার কিছুই আসে যায় না, কারণ জীবাত্মা তথা নফ্স হতে সেই পুরো পা-টি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সুতরাং আমার মেজাজি কবরে যাওয়াটা অথবা মেজাজি চিতা বা শ্মশানে দাহ করবার প্রশ্নই আসতে পারে না। কারণ লাশটিতে তথা মরা দেহে আমার আর অবস্থান থাকে না, তাই এই বিষয়টিতেও গবেষকেরা মনের অজান্তে ভুল করে বসেন, এবং সুস্থ চিন্তাটিকে রোগা করে ফেলেন এবং নানা প্রকার আবোল-তাবোল, উল্টাপাল্টা এবং আজগুবি মনগড়া দর্শন প্রচার করে দর্শকের পাতে বিভ্রান্তির লাবড়া তুলে দেয় : এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য, এটাই আমাদের পোড়া কপাল। আচার-অনুষ্ঠান যখন মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হারিয়ে ফেলতে থাকে, তখনই সেই আচার-অনুষ্ঠানগুলো অনাচারে পরিণত হয় এবং বিভ্রান্তির গোলক-ধাঁধা আপনা আপনিই তৈরি হয়। ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিলেই বৈরাগ্য হয় না, বরং নিজের ভিতর খান্নাসরূপী শয়তানটিকে মোরাকাবার ধ্যানসাধনার মাধ্যমে তাড়িয়ে দিতে পারলেই হয় সত্যিকার বৈরাগ্য। সুতরাং কোন মানুষই মেজাজি কবরে যায় না, এবং আল্লাহর কোনো অলী মাজার বা রওজায় অবস্থান করেন না : অবস্থান করে সাধারণ মানুষের লাশটি, অবস্থান করে মাজার ও রওজাতে অলীদের পবিত্র নুরানি লাশ মোবারক। সুতরাং অলীদের মাজার ও রওজা একটি পুতপবিত্র চিহ্ন বা নিশানা ছাড়া কিছুই নয়। অবশ্য প্রাচীন কালের সেমিটিক চিন্তাধারার গোবর-গণেশী-মার্কা চিন্তাধারার ফসল অনেক গবেষকের মন-মস্তিষ্কে জিনের আছরের মত ভর করে বসে। সুতরাং চরম সত্যে এই গবেষকদেরকেও দোষারোপ করা যায় না, যদিও এদের দর্শনগুলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত দূষিত, কলুষিত এবং কলঙ্কিত : অথচ এই গবেষকেরা মনে করেন যে, বিরাট বিরাট কর্মের দায়িত্ব পালন করে গেলাম। আরও একটি কথা বলা প্রযোজন যে, এইসব শ্রদ্ধেয় গবেষকরা না বুঝে না শুনে মজ্জুব মাস্তানদেরকে যা-তা গালাগালি করতে দ্বিধাবোধ করেন না, এমনকি এদের অর্ধ-উলঙ্গ অথবা উলঙ্গ অথবা লাল শালুকাপড় পরা দেখে ভন্ড বলতেও সামান্য চিন্তাভাবনা করেন না। পরিশেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আমি মেজাজি কবরে যাব না, যেতে পারি না এবং যাবার বিধান নাই। যেহেতু আমার দেহটি আমারই পরিচয় এতকাল বহন করছিল, তাই মনের মধ্যে একটি ভুল ধারণা হয় যে, আমিও দেহের সঙ্গে কবরে যাব। এই ভুল ধারণাটি ইচ্ছাকৃত নয়, মনের অজান্তে এই ভুল ধারণাটি আপনা আপনি এসে যায়। আমি কখনোই মেজাজি শ্মশানে যাব না, যেতে পারি না এবং যাবার বিধান নাই। মেজাজি শ্মশানে আমার দেহটিকে জ্বালাবে, আমাকে নয়। কারণ আমি সমস্ত দেহ হতে বিদায় গ্রহণ করেছি, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি; সুতরাং আমার লাশটাই মেজাজি শ্মশানে জ্বলবে। আমি নামক জীবাত্মাটি জ্বলবে না এবং জ্বলবার বিধান নাই। সুতরাং মেজাজি কবর এবং মেজাজি শ্মশান কেবল আমার লাশটিকেই ধারণ করতে পারে, আমি নামক জীবাত্মাটিকে ধারণ করতে পারে না এবং ধারণ করার বিধান নাই। জীবাত্মা দেহধারণ করলেই পাপ-পুণ্যের প্রশ্ন আসে। জীবাত্মা দেহধারণ না করলে পাপ-পুণ্যের প্রশ্নটি অবান্তর। বিদ্যুতের প্রকাশস্থল হল বাল্বটি। বাল্বের মধ্যেই বিদ্যুৎ আলো ছড়ায় এবং আলোর প্রকাশ ঘটে। কিন্তু মনে হবে বাল্বই বিদ্যুৎ। যখন বাল্বটি বিদ্যুৎ প্রকাশের উপযুক্ততা হারিয়ে ফেলে তখনই বাল্বটি নামধারণ করে ফিউজ বাল্ব, তথা আলো ছড়ানোর শক্তি আর নাই, তথা মরা বাল্ব। মরা বাল্ব জঞ্জাল, তাই ফেলে দেওয়া হয়।
মারেফতের বানী
ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী