
বাবা জাহাঙ্গীর এর কোরানের অনুবাদ ও প্রচলিত অনুবাদের পার্থক্য
পবিত্র কোরানুল মাজিদ-এর ১৭ নং সূরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে-
“সুবহানাললাজি আসরা বে-আবদেহি লাইলান।” ‘ভাসমান ঐ সত্তা যিনি তাঁর বান্দাকে ভ্রমণ করিয়েছেন রাত্রির মধ্যে।’
এই আয়াতের আবদেহি শব্দটির টীকায় বলা হয়েছে- কালা বে-আবদেহি দূনা নাবীয়্যেহি লাইলান ইয়াতাওয়াহামু ফিহে নাবুওয়াতান ওয়া বেলায়েতেহি। কালাল ইমামু ফি তাফসিরেহি আননাল অবুদিয়াতা আফজালুন মিনার রেসালাতে। বলা হলো, বে-আবদেহি। নবী ব্যতীত। (অথচ এই আয়াতে নবি বলা হয় নি)। ঐ রাত্রিতে যাহাতে আমরা বুঝতে পারি তার মধ্যে নবুয়ত এবং রেসালতকে বলা হয় নি।
ইমাম সয়ুতি তাঁর তফসিরের মধ্যে বলেছেন, নিশ্চয়ই উবুদিয়াত (দাসত্ব) রেসালত হইতে উত্তম।(তফসিরে জালালাইন ২২৮ পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য)।
এখানে বাক্যে আবদেহি বলা হলো অথচ নবি বলা হয় নি। নবুয়ত এবং বেলায়েত এবং রেসালত কখনোই আবদিয়াতের(দাসত্বের) সমতুল্য নহে। তাই নবুয়ত, বেলায়েত এবং রেসালত শব্দগুলোর কোন একটিকেও এই আয়াতে না এনে আবদিয়াতের(দাসত্বের) মর্যাদাকে সমুন্নত করা হয়েছে। মেরাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন ঘটনাতে আবদিয়াত শব্দটি ব্যবহার করে আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন নবুয়ত, বেলায়েত এবং রেসালতের শব্দগত অবস্থানকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
কেননা, আয়াতে কারিমাতে আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন সুবহানাল্লাজি আসরা বে-নাবিয়েহি অথবা বে-বেলায়েতেহি অথবা বে-রেসালাতেহি না বলে, বরং বে-আবদেহি শব্দাটি নির্বাচন করে প্রয়োগ করেছেন।ইহাতেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, নবুয়ত, রেসালাত এবং বেলায়েত লাভ করা যতটুকু না কষ্টকর তার চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশি কষ্টকর হলো নিজেকে আবদিয়াতের(দাসত্বের) পথে এগিয়ে নেওয়া ও প্রতিষ্ঠিত করা। (ইহা অপ্রিয় সত্য হলেও বলতে হয় যে, কোরানুল হাকিম-এর এই চারটি শব্দের প্রতিটির ক্ষেত্রে যে কোনো ব্যক্তির শব্দের গুনে গুণান্বিত হওয়া একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ রহমত ব্যতীত অসম্ভব)।
সূরা বনি ইসরাইলের ৭৮ নং আয়াত-
‘আকিমিস সালাতা লেদুলুকিশ শামসে ইলা গাসাকিল লাইলে ওয়া কোরানাল ফাজরে,ইন্না কোরানাল ফাজরে কানা মাশহুদান।’ অর্থাৎ ‘সালাত কায়েম করো (আকিমুস সালাতা)সূর্য ঢলে যাবার কারণে (লেদুলুকিশ শামসে) রাত্রির অন্ধকারের দিকে।(ইলা গাসাকিল লাইলে)এবং ভোরের কোরান (কোরআনাল ফাজরে)।নিশ্চয়ই ভোরের কোরান হয়, প্রমাণিত। (ইন্না কোরআনাল ফাজরে কানা মাশহুদান)।’
সূরা মোদ্দাছেরে ৩১ নং আয়াত- ‘ওয়া মা জাআলনা আসহাবান নারে ইললা মালাইকাতান।’
এবং আমরা নির্বাচন করি না (ওয়া মা জাআলনা)আগুনের অধিবাসী (আসহাবান নারে)ফেরেশতা ব্যতীত (ইললা মালাইকাতান)।
সূরা বাকারার ১৯ নং আয়াত- ‘আও কাসাইয়েবিন মিনাস সামায়ে ফিহে জুলুমাতুন ওয়া রাআদুন, ওয়া বারকুন, ইয়াজআলুনা আসাবেআহুম ফি আজানেহিম মিনাস সাওয়ায়েকে হাদারাল মাউতে, ওয়াল্লাহু মুহিতুন বিল কাফেরিনা।’
অথবা(আও) উহা প্রবল বৃষ্টিপাতের মতো, (কাসাইয়েবিন) যাহা বর্ষণ হয় আকাশ হইতে (মিনাস সামায়ে) উহার মধ্যে রহিয়াছে অন্ধকার (ফিহে জুলুমাতুন) এবং বজ্র (রাআদুন) এবং বিদ্যুৎ (বারকুন)।(তাহাতে তাহারা) নির্বাচন করে (ইয়াজআলুনা) তাহাদের অঙ্গুলিসমূহ (আসায়াবেহুম) তাহাদের কর্ণসমূহের মধ্যে (ফি আজানেহিম) বজ্রধ্বনি হইতে (মিনাস সাওয়ায়েকে) যখন উপস্থিত হয় তাহাদের মৃত্যু (হাদারাল মাউতে) এবং আল্লাহ (ওয়াল্লাহু)পরিবেষ্টিত রহিয়াছেন (মুহিতুন) কাফেরদের দ্বারা (বিল কাফেরিনা)।
সূরা হিজরের ৯ নং আয়াত- ইন্না নাহনু নাজজালনাজ জিকরা ওয়া ইন্না লাহু লাহাফেজুনা।
নিশ্চয়ই আমরা (ইননা নাহনু) নাজেল করি (অবতীর্ণ) জেকের (নাজজালনাজ জিকরা) এবং নিশ্চয়ই আমরা তাহার জন্য (ওয়া ইননালাহু) অবশ্যই হেফাজতকারী (সংরক্ষণকারী) (লা হাফেজুনা)।
কোরান-এর ১৯ নং সূরা মরিয়ম-এর ১৭ নং আয়াতের অনুবাদ ও সামান্য ব্যাখ্যাঃ
‘ফাত্তাখাজাত মিন দুনিহিম হেজাবান। ফা আরসালনা ইলাইহা রুহানা ফাতামাসসালা লাহা বাশারান সাউইইয়ান।’
সুতরাং সে তাহাদের হইতে (পরিবার পরিজন)পর্দা গ্রহণ করিল। সুতরাং আমরা তাহার দিকে আমাদের রুহকে পাঠাইলাম। সুতরাং তাহার জন্য উহা বাশার (আদম)-রূপে প্রকাশিত হইল।
রুহ যে বাশার (এখানে ইনসান শব্দটি ব্যবহার করা হয় নি)-রূপ ধারণ করতে পারেন, এই আয়াতেই একটি স্পষ্ট দলিল পেলাম ৷ রুহ যদিও স্বয়ং আল্লাহ এবং আল্লাহ যে বাশার-রূপ ধারণ করেন এই আয়াতটিই দলিল দেবার জন্য যথেষ্ট মনে করি। এবং রুহ যে কেবল বাশার-রূপই ধারণ করতে পারেন তা নয়, বরং রসুলও যে কোনো রূপ ধারণ করতে পারেন তারও দলিলটি পেলাম। এখানে এই কথাটি বলা হয় নি যে, সুতরাং আমরা তাহার দিকে নফসকে পাঠাইলাম তথা ফা আরসালনা ইলাইহা রুহানা বলা হয়েছে, কিন্তু ফা আরসালনা ইলাইহা নাফসানা বলা হয় নি। (আমাদের অনুবাদ এতই হুবহু হয় যে ভাষার লালিত্য রাখতে কষ্ট হয়)।
আপনি যে কোনো কোরান-এর অনুবাদ ও তফসির খুলে দেখুন যে,মাশাল্লাহ, এই রুহ বলতে জিবরিল নামক ফেরেশতাকে বোঝানো হয়েছে বলা হয়েছে। অথচ আল্লাহ পাক কেবলমাত্র আদমের ভেতর রুহ ফুৎকার করেছেন। ইহা একটি কোরান-এর জাজ্বল্যমান স্পষ্ট দলিল। কেবল জিবরিল কেন, আল্লাহ সমস্ত ফেরেশতাকে এই বলে প্রশ্ন করেছিলেন যে, তোমাদের জ্ঞান কি আদমের সমান? প্রতি-উত্তরে সমস্ত ফেরেশতারা একবাক্যে বলে ফেললেন, লা ইলমালানা ইললা মা আললামতানা তথা আমাদের কোনো জ্ঞান নাই আল্লাহ যা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন তা ব্যতীত। পাঠক বাবা, আপনি সরল বিশ্বাসে যে কোনো জাঁদরেল আলেমের এই অনুবাদটি পড়ে জিবরিল ফেরেশতার কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ফেলবেন। কিন্তু ইহা যে একটি মারাত্নক এবং জঘন্য ভুল, এটা সেই মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারবেন না।এভাবেই কোরান-এর অনুবাদ ও ব্যখ্যা অনেক স্থানে এমন উল্টাপাল্টা দেওয়া হয় যে, সরল পাঠক সত্য-মিথ্যার পার্থক্যটি আর বুঝে উঠতে পারেন না। ঢাকার পুরাতন শহরে অবস্থিত ভেজাল দুধের আড়ৎটির নাম রথখোলার দুধের আড়ৎ। এই ভেজাল দুধ খেতে খেতে পেট অনেকটা ভেজাল-প্রুফ হয়ে যায়। তখন পল্লীগ্রামে গিয়ে কোনো আত্মীয় -পরিজনের বাড়িতে দু-একদিন অবস্থান করে খাটি দুধ পান করলে পেট খারাপ হবার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়। ঠিক সে রকম ভেজাল অনুবাদ ও ব্যখ্যা পড়ে পড়ে আসলটাকেই ভেজাল মনে হয় এবং নানা রকম প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা মনের মাঝে ভেসে ওঠে এবং এটাই স্বাভাবিক।
সুফি কবি আল্লামা ইকবাল এই জাতীয় কোরান-এর অনুবাদ ও তফসিরগুলো পড়ে একটি খাসা মন্তব্য করেছিলেন এই বলে যে, এই সকল আলেম-উলামাদের কোরানের অনুবাদ ও তফসিরের নমুনা দেখে আল্লাহ, মহানবি এবং ফেরেশতারা সবাই অবাক। সুফি কবি আল্লামা ইকবালের উপর কাফের ফতোয়া দেবার প্রথম সূচনাটি এখান থেকেই শুরু হয়, তবে আলেম-উলামারা তখনও প্রকাশ্যে কিছু মন্তব্য করার সাহস পায়নি।
কোরান-এর উনিশ নম্বর সূরা মরিয়মের একচল্লিশ নম্বর আয়াতের অনুবাদঃ
‘ওয়াজকুর ফিল কিতাবে ইব্রাহীমা। ইন্নাহু কানা সিদ্দীকান নাবীয়ান ‘ তথা এবং জিকির (স্বরণ)করো কেতাবের মধ্যে ইব্রাহিমকে। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন সত্যবাদী (সিদ্দিকান) নবি।
কেতাবের মধ্যে ইব্রাহিমকে কেমন করে মনে করবে তথা স্বরণ করবে তথা জিকির করবে? কারণ তখন কেতাবের সন্ধান কোথায় পাবে, যদি উহা কাগজ অথবা অন্য কিছুতে লিখা থাকে? আর তা ছাড়া কেতাব পড়ার মতো অক্ষরপরিচয় তাঁর জানা ছিল না। তা হলে এই কেতাব বলতে কি আল্লাহর প্রকাশ ও বিকাশের অবিরাম ছুটে চলার গতিকে বুঝানো হয়েছে? যদি তাই হয়,তা হলে নুরময় কেতাব হতেই ইব্রাহিমকে জানবার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। কারণ হজরত ইব্রাহিম আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে চলে গেছেন। আমরা দেখতে পাই, কোন বিষয় জানার জন্য আল্লাহ কেতাবের জিকির করার কথাটি বারবার বলেছেন। সুতরাং এই রহস্যলোকের নুরি কেতাবটি হতে কিছু জানতে হলে রহস্যলোকে প্রবেশ না করা পর্যন্ত সম্ভব নয়। তা হলে অধ্যাত্মবাদকে কেমন করে অস্বীকার করা যায়? আর যদি ধরে নিলাম উহা কাগজের কেতাব, কিন্তু সেই সময় কাগজ পাবার প্রশ্নই ওঠে না। আর ভাষাটিকে আক্ষরিক রূপদান করে সাজাবার মতো ভাষাজ্ঞানী কি তখন ছিল? তা হলে কি পরিষ্কার বোঝানো হচ্ছে না যে, ইহা এলমে লাদুনির কেতাব? তা হলে এলমে লাদুনিকে কী করে অস্বীকার করে ওহাবিরা এবং শিয়ারা? আরও উল্লেখ্য যে,কোরান -এ কেতাব বলতে কোথাও কোরান-কেই বুঝিয়েছে, আবার আল্লাহর প্রকাশ ও বিকাশের অবিরাম ছুটে চলার গতিকেও কেতাব বলা হয়েছে। সুতরাং একপেশে করে বুঝতে গেলেই ভুল করা হয়। সুফিবাদে বিশ্বাসী অনেকেই কোরান-কেও যে কোনো কোনো স্থানে কেতাব বলা হয়েছে এটা মানতে নারাজ। আবার পরক্ষণে আল্লাহর প্রকাশ ও বিকাশের অবিরাম ছুটে চলার গতিকেও যে কেতাব বলা হয়েছে এটাও অনেকে মেনে নিতে নারাজ। অনেকটা যারা শরিয়ত মানেন তারা মারেফত মানেন না, আবার যারা মারেফত মানেন তারা শরিয়ত মানেন না। কারণ আল্লাহর কালামে পাক কোরানুল হাকিম-এ উভয়ের সমন্বয়টি দেখতে পাই। যেমন আমরা জানি ওহি নবি-রসুলের কাছেই নাজেল করা হয়, অথচ হজরত মুসা (আঃ)-এর মায়ের কাছেও ওহি আসার কথাটি জানতে পারি এবং আরও অবাক হবার কথাটি হলো যে, সূরা নহলের ৬৮ নং আয়াতের প্রথমেই মৌমাছির কাছেও ওহি নাজেল করা হয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ওহি একটি মাত্র শব্দ হলেও তিনটি স্থানে তিন রূপ। তাই বলে একজন বিবেকবান মানুষ মৌমাছির নামের পরে ‘আলাইহেস সালাতুস সালাম’ ব্যবহার কখনোই করতে যাবেন না। কারণ যেহেতু মৌমাছির কাছেও ওহি নাজেল হয়, তাই বলে কি মৌমাছি আলাইহেস সালাতুস সালাম কি বলা যায়? না,যায় না।
কোরান-এর তিপ্পান্ন নম্বর সূরা নজমের তেতাল্লিশ নম্বর আয়াতের অনুবাদ ও সামান্য ব্যাখ্যাঃ
‘ওয়া আন্না হুয়া আদহাকা ওয়া আবকা।’
এবং নিশ্চয়ই তিনি(তোমাকে) হাসান (আদহাকা)এবং(তোমাকে) কাঁদান (আবকা)।
ব্যাখ্যাঃ এই আয়াতটি পড়ার পর অবাক হই, কিন্তু এটা তো সর্বশক্তিমান আল্লাহর কালাম, তাই মাথা পেতে মেনে নিতেই হবে। তবে একটি কথা মনে পড়ে বারবার আর সেই কথাটি হলো,বাংলার সহজ-সরল বাউল যখন লাল শালু কাপড় পরে খাল বা নদীর তীরে বা কোনো নির্জন স্থানে আপন মনে দোতারায় সুর তুলে গাইতে থাকে বাংলায় বিখ্যাত সুফি সাধক খালেক দেওয়ানের পিতা আলেফ দেওয়ান রচিত তুমি যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কি দোষ? জানতাম না এবং ঐ সরল-সহজ বাউলও হয়তো জানে না যে, এটা কোরান -এরই অনেকটা ভাবার্থ, এটা সূরা নজমের তেতাল্লিশ নম্বর আয়াতটির কিছুটা দর্শন গেয়ে চলছে।
কোরান কী অপূর্ব ভাষার শৈলীতে প্রকাশ করছে যে, একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহপাকই সবাইকে হাসান এবং সবাইকেই কাঁদান। আমরা অবশ্য কালামটিতে ব্রাকেট তৈরি করে আমাদের বুঝবার জন্য মানবজাতিকে বোঝাতে চেয়েছি। যদিও জিনজাতির কথাটি ইচ্ছা করেই বাদ দিয়েছি। কিন্তু কোরান বলছে, তিনিই হাসান এবং তিনিই কাঁদান। কালামটি কিন্তু সার্বজনীন।অবশ্য আমরাও সার্বজনীন বলতে কেবলমাত্র মানবজাতিকেই বুঝি। কিন্তু আল্লাহপাকের সার্বজনীন শব্দটির অর্থ হলো সৃষ্টিজগতের সবার বেলায় প্রযোজ্য। তিনি তাঁর সৃষ্টিজগতের সবাইকে হাসান এবং সবাইকে কাঁদান। নবী সোলায়মান পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গের ভাষা বুঝতেন। বুঝতেন এদের সুখ-দুঃখের ভাষা। বুঝতেন এদের হাসি আর কান্না। হুদহুদ পাখি তো বলেই ফেললো যে, আমি যা জানি নবিবর সোলায়মান তা জানেন না। একটু গবেষণা করুন । সব বিষয়ের গবেষণা চলছে এবং গবেষণায় নূতন নূতন বিষয় বেরিয়ে আসছে আর আমারা সেইসব দেখে অবাকের পর অবাক হচ্ছি। গবেষণায় ভুল থাকতে পারে, কিন্তু ইচ্ছাকৃত নয়। কিন্তু থামিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। কারণ কোরান গবেষণাকে উৎসাহ দেবার জন্য বলছে যে, সমস্ত গাছগুলো যদি কলম হয়, আর পানিগুলো কালি হয়, তবুও কোরান-এর ব্যাখ্যা লিখে শেষ করা যাবে না।
আমরা মতের বিভিন্নতার দরুন মতভেদ দেখতে পাই। তবে হিংস্রতা, বর্বরতা এবং জানমালের নিরাপত্তার প্রশ্নে মহানবি আগেই সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে যে, সে-ই মুসলমান, যার হাত সর্বপ্রকার আমানত এবং অনিষ্ট হতে মুক্ত থাকে। ইতিহাস খুলে দেখুন যে, মুসলমানরা যখন সভ্যতার শীর্ষে,তখন ইউরোপ আর আমেরিকার অবস্থানটি কেমন ছিল। জংলি রেড ইন্ডিয়ানদের বাস ছিল আমেরিকায়। এটা সবাই জানে। ব্রিটেন গোঁয়ারগোবিন্দ আর বর্বরতার অন্ধকারে যে ছিল তার অনেক অনেক প্রমাণ পাই। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে এই সত্য কথাটি প্রচার করার দরুন এই সেদিনও কত বড় বড় জ্ঞানীদেরকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে এবং আরও কত কী! আর আজ? যে সভ্যতার মশালটি মুসলমানের হাতে ছিল সেই মশালটি এখন গোঁয়ারগোবিন্দদের হাতে শোভা পাচ্ছে। আর আমাদের স্থান কোথায় নেমে গেছে সেটাও কি বলতে হবে? হয়তো যুক্তির খাতিরে বলতে পারেন যে, আল্লাহই যখন হাসান এবং কাঁদান তা হলে তাদেরকে হাসাচ্ছে আর আমাদেরকে কাঁদাচ্ছে! (সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে যখন আওলাদে রসুল ইমাম জয়নুল আবেদিন (আঃ)-কে মোয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ সূরা আল ইমরানের ছাব্বিশ নম্বর আয়াতটি শুনিয়ে দিলো, তখন ইমাম সাহেব কেবলমাত্র একটি কথাই বলেছিলেন যে, শয়তানের মুখেও আজ আমাকে কোরান-এর বানী শুনতে হলো)। এর উত্তর আমার জানা নাই। তবে আল্লাহ এটাও বলে দিয়েছেন যে, যে জাতি তার নিজের ভাগ্য নিজেরা পরিবর্তন করে না আল্লাহ সেই জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না। ভাগ্য পরিবর্তন করা যায় না-বলা হলে এখানে ভাগ্য পরিবর্তনের কথাটি আসে কেমন করে? ভাগ্য তথা তকদির দুই প্রকারঃ একটি বদলানো যায় এবং আর একটি যায় না। তথা মুবরাম তকদির নির্দিষ্ট। মুবরাম তকদিরের পরিবর্তন হয় না।(তকদির বিষয়টি নিয়ে তৃতীয় খন্ডে বিস্তারিত লিখার আশা রাখি। বাকি আল্লাহপাকের ইচ্ছা।)
কোরান-এর পঞ্চান্ন নম্বর সূরা আর রহমানের ৫০ নম্বর (ছোট্ট একটি) আয়াতের অনুবাদ ও সামান্য ব্যাখ্যাঃ ‘ফীহিমা আইনানে তাজরিয়ানে।’
তাহাদের মধ্যে রহিয়াছে (ফিহিমা) প্রবহমান (তাজরিয়ানে) দুইটি চক্ষু (আইনানে)।
ব্যাখ্যাঃ আইনানে শব্দটিকে ঝরনা লিখেছেন সবাই প্রবহমান শব্দটি থাকার কারণে। অথচ ইহার অর্থ হলো দুইটি চক্ষু অথবা দুইটি কূপ। কূপ-কে অনুবাদকারী গ্রহণ করেন না। কারণ কূপে প্রবাহ থাকে না।কিন্তু চক্ষুতে যে প্রচন্ড বোবা প্রবাহটি বিদ্যমান উহা অনেকেই বুঝতে পারেন না। তাই ঝরনা অথবা প্রস্রবণ শব্দটি ব্যবহার করতে বাধ্য হন। অথচ ঝরনা অথবা প্রস্রবন শব্দটির নাম-গন্ধও শব্দটিতে নাই।আমি পনেরটি আরবি ডিকশনারি খুলে একটিতেও ঝরনা অথবা প্রস্রবণ শব্দটি পেলাম না। চোখের প্রবাহ যে সাগরের প্রবাহ হতে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং প্রবহমান নদী-নালার তো চোখের প্রবাহের সামনে তুলনাই চলে না। অনুবাদক দুইটি চোখ, দুইটি কূপে প্রবাহটি দেখতে না পেয়ে দুইটি চক্ষুকে দুইটি প্রস্রবণ অথবা ঝরনা অনুবাদ করতে বাধ্য হন। অনুবাদক অকপটে যদি লিখে দিতেন যে, এই আয়াতটির হুবহু অনুবাদ করে গেলাম, কিন্তু অর্থটি বুঝতে পারলাম না, তা হলে অনুবাদকের মহত্ত্বই প্রকাশ পেত। ‘সব কিছু বুঝে গেছি’ বলাটা যে পাপ এটা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে দার্শনিক সক্রেটিস বারবার বলে আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছেন। বুঝতে পারলাম না, বলার মাঝে মূর্খতা নাই, আছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে বুঝবার দরজাটি খুলতে পারে তারই অকপট স্বীকৃতি। চীন দেশে একটি প্রবাদ আছে, সামান্য জিহবাটি কত মানুষ খুন করতে পারে। কিন্তু দুইটি চক্ষুর যে কত শক্তিশালী প্রবাহ আছে এবং দুইটি চোখ অন্ধ থাকলে সভ্যতার প্রবাহটি কি ধেই ধেই করে এগিয়ে যেতে পারত?দৈহিক প্রেম এবং আধ্যাত্মিক প্রেমের প্রশ্নেও বড় বড় কবিরা বলেছেন যে, আখুকা এক ইশারাই কাফী হ্যায়। তথা চোখের একটি ইঙ্গিতই যথেষ্ট। ধনাঢ্য মাহওয়াল, মাটির হাঁড়িপাতিল বানায় এমন কুমোরের মেয়ে সোহনির একটি দৃষ্টিতেই প্রেমসাগরে ডুবে মারা গেলেন। শরিয়ত এবং মারেফতের মিলন পাই কোরান-হাদিসের বাণীতে। আমরা ইচ্ছা করে একপেশে হয়ে যাই। ওহাবিরা তো মারেফতের হাদিসগুলোকে একদম মানে না। এ জন্যই হয়তো ঝানু ওহাবি আর ঝানু শিয়া গবেষকদের সাহাবা আবু হুরায়রাকে যা-তা মন্তব্য করতে দেখি। কিন্তু সূরা কাহাফের খিজির যে এলমে গায়েব জানতেন সেই বিষয়টি সযতনে এড়িয়ে যান। এড়িয়ে যান সূরা আল ইমরানের ৪৯ নম্বর আয়াতের এলমে গায়েব জানার পরিষ্কার দলিলটি। এক জাঁদরেল ওহাবি পন্ডিতকে বলেছিলাম যে, মৃতকে জীবিত করাটিকে আপনারা বলেন মৃত আত্মাকে জ্ঞান দিয়ে জীবিত করেন। আপনাদের এই ব্যাখ্যা মেনে নিলেও একটি কথা থেকে যায়, আর সেটা হল এই রকম জ্ঞান দেবার বিষয়টি যে যে স্থানে কোরান-এ আছে সেখানে কিন্তু ‘বেইজনিল্লাহু’ তথা আল্লাহর হুকুমে কথাটি নাই, কিন্তু লাশের মধ্যে প্রাণ দেবার প্রশ্নে ‘বেইজনিল্লাহু’ তথা আল্লাহর হুকুমে থাকতেই হবে। আর মাটি দিয়ে বানানো পাখিতে ফুৎকার দেবার সাথে সাথে জীবন্ত পাখি হয়ে উড়ে যাবার কথাটি যে কোরান বলছে সেটার ব্যাখ্যা কী দিবেন? গোয়েন্দারা বলেন যে, অপরাধী কিছু না কিছু সামান্য হলেও অপরাধের চিহ্ন রেখে যায় এবং চিহ্ন দ্বারা যদি অপরাধী ধরা পড়ে তো কিছুই বলার থাকে না। তখন মাথা নিচু করে কেউ অপরাধ স্বীকার করে, আবার কেউ এই জলজ্যান্ত প্রমাণ দেখেও অস্বীকার করে। একজন এই বিষয়টি মানবে কি মানবে না, তা জন্মের পূর্বেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে।মেশকাত শরিফ-এ তকদির বিষয়ে হাদিসগুলো পড়ে দেখলে পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। সুতরাং গালি না দিয়ে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিন। আর এলমে গায়েবের কথা? শত দলিল দাঁড় করালেও ওহাবিরা মানবে না। তবে যদি কেবলমাত্র একটি দলিল দিতে চাই, আর তা হলো ফারুকে আজম হজরত ওমর ফারুক মসজিদে খুৎবা পড়ার সময় বহু দূরে যুদ্ধে রত সাহাবাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আশা করি এই দলিলটি যথেষ্ট। কারণ সাহাবার শান যদি এমন হয়, তো গায়েব সম্পর্কে মহানবির শান কেমন হতে পারে?
বনি ইসরাইল সূরাতে মুসা ও খিজিরের বিষয়টিতে বলা হয়েছে, আমি তাকে (খিজির) ইলমে লাদুনি দান করেছি।খিজির নবিও নন, রসুলও নন। তিনি ওলি। কোরান-এর সূরা আল ইমরানের ঊনপঞ্চাশ নম্বর আয়াতের শেষে হজরত ইসা (আঃ) তাঁর সাহাবাদেরকে বলেছেন যে, তোমরা কী খাবার খেয়ে এসেছ তা আমি বলে দিতে পারি এবং তোমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে কোথায় কোন জিনিস রাখা আছে তাও বলে দিতে পারব। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, এই একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের মধ্যে কারো তার নিজ বাড়িতে কোথায় কী রাখা আছে তা বলা এক প্রকার অসম্ভব বলতে চাই। কোরান-এর এই আয়াতগুলো কি এলমে গায়েবের প্রকাশ্য প্রমাণ বহন করে না? একইভাবে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে আল্লাহ কোরান-এ বলছেন যে, ‘আমি এইভাবেই ইব্রাহিমকে আকাশ ও ভূমন্ডল পরিব্যাপ্ত আমার (আল্লাহর) বাদশাহি অবলোকন করাই।’
তফসিরে রুহুল বয়ান এবং তফসিরে কবির এবং তফসিরে খাযেন-এ বর্ণনা করা হয়েছে, নবি হজরত ইউসুফ (আঃ) বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে বিগত ও ভবিষ্যৎ দিনগুলোতে তোমাদের রিজিক এবং যাবতীয় অবস্থা সম্বন্ধে বলে দিতে পারি। তোমাদের জন্য আসা খাদ্যশস্য কোথা হতে এলো এবং এরপর কোথায় যাবে, আমি এই বিষয়টিও জানি এবং তোমাদেরকে জানিয়েও দিতে পারি। আমি এটাও পরিষ্কার বলে দিতে পারি যে, এই খাবার গ্রহণে তোমাদের উপকার হবে কি ক্ষতি সাধিত হবে।’ এলমে গায়েব জানা না থাকলে এ রকম কথাগুলো বলা অসম্ভব।
ফারুকে আজম হজরত ওমর ফারুক হতে এই হাদিসটি মেশকাত শরিফ-এ আছে যে, ‘মহানবি সৃষ্টির আদিকালীন সংবাদ দিচ্ছিলেন। এমনকি বেহেশতি এবং দোষীদের নিজ নিজ ঠিকানায় পৌছে যাওয়া অবধি যাবতীয় ঘটনাবলির বিস্তারিত বর্ণনা করেন।’ সাহাবা হজরত হুজাইফা বলেছেন যে, মহানবি উল্লেখিত সমাবেশে কেয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে সব কিছুর খবর দিয়েছেন। তাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই সেই সকল বর্ণনা মনে রাখতে পেরেছেন।
মেশকাত শরিফ-এ আছে যে, সাহাবা হজরত সওবান বলেছেন যে,মহানবি বর্ণনা করেছেন, ‘আল্লাহ আমার (মহানবি) সামনে পৃথিবীকে এমনভাবে সংকুচিত করে দিয়েছেন যে, আমি পৃথিবীর পূর্বপ্রান্ত হতে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত সমস্ত কিছু অবলোকন করেছি।’ মেশকাত শরিফ- এ আছে যে, সাহাবা হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আয়েয বলেছেন যে, মহানবি বলেছেন- ‘আমি আল্লাহকে সুন্দরতম আকৃতিতে দেখেছি। তিনি (আল্লাহ)তাঁর কুদরতের হাত আমার বুকের উপর রাখেন, যে হাত পাকের সুশীতল পরশ আমি আমার অন্তরের অন্তস্তলে অনুভব করি এবং এর ফলে আমি আসমান-জমিনের সমস্ত বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়েছি।’ মেশকাত শরিফ-এ বর্ণিত আছে যে, হজরত উম্মুল ফজল ভবিষ্যদ্বাণী করে এরশাদ করেন, ‘খাতুনে জান্নাত মা ফাতেমাতুজ জোহরা (আঃ)-এর কোলে একজন পুত্রসন্তানের আবির্ভাব ঘটবে এবং সে পুত্রসন্তান উম্মুল ফজলের কোলে লালিতপালিত হবেন।’ বুখারি শরিফ হতে সাহাবা হজরত ইবনে আব্বাস বলেছেন যে, ‘মহানবি একদিন দুইটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন কবর দুইটিতে আজাব হচ্ছিল। তিনি (মহানবি) সঙ্গী সাহাবাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই কবর দুইটিতে আজাব হচ্ছে। কিন্তু কোনো বড় গুনাহর জন্য নয়।’ তখন মহানবি একখানি খেজুরের কাঁচা ডাল নিয়ে সেটিকে ভেঙে দুই টুকরা করলেন এবং সেই দুইখানিকে একটি করে এক এক কবরে পুঁতে দিলেন এবং এরশাদ করেন যে, যতদিন পর্যন্ত এই খেজুরের ডাল শুকিয়ে না যাবে, ততদিন পর্যন্ত এদের কবরের আজাব কম হবে। মসনদে ইমাম হাম্বল হতে বর্ণিত আছে যে, মহানবী তাঁদের কাছে এমনভাবেও বর্ণনা করেন যে, পৃথিবীতে একটি পাখির ডানা নাড়ার কথাও সেই বর্ণনা থেকে বাদ পড়ে নি। তিরমিজি শরিফ-এও এই বর্ণনাটি আছে, মহানবি বলেন, ‘তখন প্রত্যেক কিছু তাঁর (মহানবি) কাছে এমনভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে যে, তিনি (মহানবি) এইগুলি চিনতে পেরেছেন।’ আল্লামা জুরকানি এই হাদিসখানি সম্বন্ধে তাঁর শরহে মাওয়াহেব কিতাবে লিখেছেন যে, মহানবির সামনে দুনিয়াকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যার ফলে তাঁর (মহানবি) দৃষ্টি সেই সমস্ত বস্তুকে পরিবেষ্টন করেছে। সুতরাং তিনি (মহানবি) পৃথিবীকে এবং যা কিছু কেয়ামত পর্যন্ত ঘটতে থাকবে এমনভাবে দেখতে পেয়েছেন যেমনভাবে তাঁর (মহানবি) হাত মোবারককে দেখতে পান। হাত মোবারকের তুলনা এই কারণেই দেওয়া হয়েছে যে, কোনোরকম দিব্যদৃষ্টি বা কল্পদৃষ্টি নয়, অতি বাস্তবতা দিয়েই তিনি (মহানবি) সেই সমস্ত কিছু প্রত্যক্ষ করেছেন।
– ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী