
ইসলামী সাম্যবাদ ও ইসলামী খিলাফতের স্বরূপ
ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী
খলিফা উমর ফারুক (রাঃ) ইসলামী সাম্যবাদের আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত সত্যরূপে সেই যুগে, সেই পরিবেশে, সেই অসভ্যতার জের সবেমাত্র কেটে-উঠা সমাজের বুকে গোলাম আর মনিব উভয়কে একই মানের এবং একই পরিমাণ বেতন দেবার ব্যবস্থা করে অপূর্ব দৃষ্টান্ত অনাগত কালের পৃথিবীর নাগরিকদের জন্য রেখে গেলেন। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নাগরিকেরা যেন ইসলামের এই সুন্দরতম আদর্শ মনে-প্রাণে গ্রহণ করে নিতে পারে তারই দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সেই যুগে কতখানি কষ্টসাধ্য তাহা সহজেই বুঝা যায়। সেই যুগে গোলাম ছিল আরবদের কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং ঘৃণিত শ্রেণী। হুজুর পাকের (দঃ) গোলাম হযরত যায়েদের (রাঃ) পুত্র হযরত উসামার (রাঃ) বেতন অন্যান্য মনিবদের সমপরিমাণ হওয়াতে খলিফা উমর ফারুকের (রাঃ) পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) পর্যন্ত প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই যুগের কথা বাদ দিয়ে আমাদের সভ্য যুগে কেউ যদি প্রস্তাব করে যে, দারোয়ান পিওন এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারী একই পরিমাণ বেতন পাবে তবে আমাদের জনদরদী নেতাগণ হাউমাউ করে চিৎকার মেরে প্রতিবাদ করবে এবং আজকের যুগে প্রতিবাদ করা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ইসলামের চরম আদর্শ প্রতিষ্ঠার কল্পনা ছিল উহাই, সামান্য দুনিয়ার মূল্যহীন বস্তুপ্রাপ্তির অসাম্য তৈরি না করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। একই খাদ্য, একই পোশাক পরিধান করাতে সম্মানের উঁচু-নিচুর পার্থক্য হয় না। পার্থক্য হয় এবং হবে ঈমানের গভীরতা এবং তাকওয়ার উপর ভিত্তি করে। ছোট-বড় এই অসাম্যর প্রবাহকে হযরত উমর ফারুক (রাঃ) অসভ্য যুগের ঘৃণ্য আচরণ বলে বার বার ঘোষণা করেছেন এবং আরব জনসাধারণ যাতে এই হিংসাত্মক অহংকার হতে রেহাই পায় তার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন এবং এই পরিশ্রম যে সেই যুগে বেশ কিছুটা কিছুদিনের জন্য সাফল্যমন্ডিত হয়েছে তাঁর নজির তার নির্বাচিত প্রধান সেনাপতিদের চরিত্রে ফুটে উঠেছে অপূর্বরূপে। ইরাক বিজয়ের সময় প্রধান সেনাপতি আবু ইবায়দা যখন সাকাতিয়া নামক স্থানে শিবির স্থাপন করলেন তখন সেই সাকাতিয়ার দুইজন বিখ্যাত সরদার ফারুক এবং ফেরাওয়ান্দ মুসলমানের বশ্যতা মেনে নিলেন। একদিন এই দুই সরদার দামী খাদ্য তৈরি করে আবু উবায়দাকে খেতে বললে আবু উবায়দা প্রশ্ন করলেন, ‘সমস্ত সৈনিকদের জন্য কি এই খাদ্য আনা হয়েছে, না শুধু আমার জন্য?’ সরদার ফারুক উত্তর দিলেন, ‘এই সামান্য সময়ের মধ্যে সকল সৈনিকদের জন্য ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি।’ আবু উবায়দা সরদারের সেই তৈরি করা খাদ্য ফিরিয়ে নিতে বললেন এবং উপদেশ দিলেন যে, ‘মুসলমানদের মধ্যে একের উপর অন্য ব্যক্তির কোনই প্রাধান্য নেই।’
ফাহাল বিজয়ের সময় রুমীয় সেনাপতি স্কলার-এর নিকট যখন দূতরূপে হযরত মা’ আয ইবনে জাবাল (রাঃ)-কে পাঠান হয় তখন একটি রুমীয় সৈন্য এসে বিলাসবহুল কক্ষে যাবার জন্য অনুরোধ করে এবং বলে আপনার ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখছি, আপনি ভেতরে যান। হযরত মা’ আয (রাঃ) বললেন, ‘গরীবের রক্ত শোষণ করে যে গালিচা বানানো হয়েছে মুসলমান তাতে বসে না। সুতরাং আমি তাতে বসতে পারি না।’ তিনি মাটিতেই বসে পড়লেন। বললেন, ‘আপনাকে উপযুক্ত সম্মান দিতে চাইলাম, কিন্তু নিজের সম্মান নিজে নষ্ট করলেন।’ হযরত মা’ আয (রাঃ) বললেন, ‘তোমরা যেটাকে সম্মান মনে করছ আমার তাতে কোনই প্রয়োজন নেই। মাটিতে বসাই যদি গোলামের রীতি হয় তবে আমার চেয়ে আল্লাহর বড় গোলাম কে আছে?’ জনৈক সৈনিক প্রশ্ন করে, ‘বলুন তো মুসলমান বাহিনীতে আপনার মত উচ্চ আদর্শের মানুষ আরো আছে কি?’ হযরত মা’ আয (রাঃ) বললেন, ‘আমার তো মনে হয়, মুসলমান বাহিনীতে আমার চেয়ে আর নিকৃষ্টতম ব্যক্তি কেউ নেই।’
গরীবের শোষকদের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে শান্তিপূর্ণভাবে সাম্য-মৈত্রীর প্রীতি প্রতিষ্ঠা করার আশা এবং প্রচার ঠিক সেই রকমই আত্মবিরোধী আশা এবং প্রচার, যে রকম একটি অবধারিত মৃত্যুপথযাত্রী বসন্ত রোগীর সঙ্গে সুস্থ-সবল মানুষটাকে একই বিছানায় রাত কাটানোর আশা এবং প্রচার করা। অথবা শিয়াল আর মুরগীকে এক ঘরে শান্তিতে বসবাস করতে দেওয়া। কারণ শিয়াল আর মুরগী খাবে না বলে কথা দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাস এবং ইসলাম এই মারাত্মক ভুলের স্রোতে যাতে শোষিতরা ঘুরপাক না খায় তার জন্য বহুবার আমাদেরকে সাবধান করে দিয়েছে, মনে রেখ বাতেল তথা অসত্য এবং হক তথা সত্য একই বিছানায় থাকতে পারে না। হয় সত্য না হয় মিথ্যা থাকবে। অসত্যের সঙ্গে সত্যের কোন আপোষ হয় না। যারা আপোষের কথা বলে শোষিতদের আশা দেয় তারা মোনাফেক। তারা ভন্ড এবং এই ভন্ডামীর ভেতর পুরো অসত্যই লিক লিক করছে। তাই সত্য নামক অস্ত্র দ্বারা যখন মিথ্যাকে আঘাত করা হয় তখন মিথ্যার মাথার খুলি চুরমার হয়ে যায় এবং সত্য তার আপন সুন্দরতম রূপটিকে নিয়ে উদ্ভাসিত হয়। সত্যের অস্ত্র ব্যবহার না করা পর্যন্ত মিথ্যা কখনোই তার আসন হতে সরতে চায় না। যারা সত্যের অস্ত্র ব্যবহার না করে মিথ্যাকে সরাতে চায় তারা পৃথিবীর ইতিহাস এবং পবিত্র কোরান পড়লেও গবেষণার নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়েন না। সত্যের অস্ত্র ব্যবহার না করে আল্লাহর সাহায্য পাবার আশা অসম্ভব। কারণ, আল্লাহ সে বিষয়ে আমাদেরকে আগেই সাবধান করে রেখেছেন – তোমাদের ভাগ্যকে যদি তোমরা পরিবর্তন করার চেষ্টায় রত না থাক তবে আল্লাহও তোমাদের ভাগ্যকে পরিবর্তন করবেন না। তাই আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছি যে, সত্যের তরবারি শোষিতরা কাঁধে নিয়ে এক মহান ঐক্যের মাধ্যমে মিথ্যার বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করতে হবে। আঘাত হানতে হবে মিথ্যার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কররূপে। ‘ইন্না আবওয়াবাল জান্নাতে তাহতা জেলালিস সয়ুফে’ ‘নিশ্চয়ই তরবারীর ছায়ার নিচেই বেহেস্তের দরজা’ হুজুর পাকের (দঃ) এই মহাবাণীই শোষিতদের একমাত্র আদর্শ। মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়ী হলে শোষিতদের গলায় ‘গাজী’ নামক মালা শোভা পাবে। মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামে মৃত্যু হলে শোষিতদের গলায় ‘শহীদ’ নামক মালা শোভা পাবে। মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামে সত্য হাতিয়ার তুলে নিয়ে সুনিশ্চিত বিজয় বলে আল্লাহ পাক কালামে বহুবার ঘোষণা করেছেন। পৃথিবীতে সত্যের হাতিয়ার তুলে নিয়েছ যারা, তারা এক হও এবং আঘাত হান মিথ্যার বিরুদ্ধে। মনে রেখ অসত্যের মৃত্যু অবধারিত, তবে সত্য বলতে কি বুঝায় এবং সত্যের আসল পরিচয় কি তা জানতে হবে, নইলে সত্য-মিথ্যার গোলক-ধাঁধাঁয় পড়ার থাকবে সম্ভাবনা। সত্য এবং মিথ্যার প্রভেদ করতে হলে সত্যকে ভাল করে প্রথমেই জেনে নিতে হবে।
এই কথায় যেন কুফুরী মতবাদে বিশ্বাসী কমিউনিস্টরা মনে না করে যে তাদের মতবাদে সাম্য আছে। পৃথিবীতে সাম্যবাদের প্রবক্তা একমাত্র মহানবী হুজুর পাক (দঃ)। মানুষকে পশু বানাবার বিদ্যা কমিউনিজমে কি রকম সাম্য বিরাজ করে তা নিজের চোখে দেখে আসলে হাজার বার তওবা পড়তে হবে, নতুবা বমি আসার উপক্রম হবে। পৃথিবীর কোন ধর্মকেই এরা মানে না বরং এরা পশুর মত খাওয়া-দাওয়া করে পশুর ডাক দেয় – ধর্মগুলো হল আফিম। তার মানে হল উনারাই পৃথিবীতে একমাত্র মহাপন্ডিতের দল। যদি কোনদিন ইসলামের দেওয়া সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং মহানবীর আদর্শ প্রতিষ্ঠিত সত্যরূপে বিরাজ করে সেদিন এদের “ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাচি’র মত অবস্থা হবে। সত্যি কথা বলতে কি – এক বেলা না খেয়ে থাকতে সবাই আমরা হাসিমুখে রাজি আছি, কিন্তু মরে গেলেও পশু বানাবার বিদ্যাকে করি হৃদয় দিয়ে ঘৃণা। কারণ, পেট ভরে খাও আর কাজ কর এবং আর কিছু নেই- এর দর্শনের সঙ্গে পশুদের জীবনের সঙ্গে সুন্দর মানায় কিন্তু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের জন্য নয়। এই প্রশ্নে যদি সামন্তবাদ, পুঁজিবাদের সঙ্গে থাকতে হয়, থাকবো, কারণ কম খেলেও পশুর মত বাঁচতে চাই না। শ্রদ্ধেয় মাওলানা মত্তদুদী সাহেবের দেওয়া ইসলামী অর্থনৈতিক দর্শনকে মানতেও রাজি আছি, তবু ‘কোন ধর্মই মানি না’র মতবাদ জীবন চলে গেলেও বরণ করে নেব না, যদিও মাওলানা মওদুদী সাহেবের মতবাদের সঙ্গে আমরা একমত নই।
⇒ মারেফতের গোপন কথা
⇒ ডা. বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী